দোয়ারাবাজার, (সুনামগঞ্জ) ২১ মে : অতিরিক্ত তাপদাহ ও খরায় এবার আশানুরূপ ফলন না হওয়ায় চরম হতাশায় ভুগছেন সুনামগঞ্জের লিচু bচাষিরা। জেলার টিলাবেষ্টিত ছাতক-দোয়ারাবাজারের হাটবাজারগুলোতে ভরা এ মৌসুমে লিচুতে ভরপুর থাকার কথা থাকলেও এবার তার ব্যতিক্রম। ফলে লাভ হওয়াতো দূরের কথা, মহাজনদের ঋণের চাপে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন লিচু চাষিরা।
জানা যায়, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গত দুই দশক ধরে বানিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ অব্যাহত রয়েছে। ওই এলাকার লিচু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম সমাদৃত হলেও দেশিয় প্রজাতির রসালো সুমিষ্ট এ লিচুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। আর এ অঞ্চলের উৎপাদিত লিচুতেই ওই দুই জেলার চাহিদা মেটানো সম্ভবপর। চলতি মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে ছাতক-দোয়ারাবাজারসহ স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে লিচুর বেচাকেনা। প্রায় লাখ টাকার লিচু বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। বর্তমানে ১শ' লিচু ২শ' থেকে ৩শ' টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছাতকের মানিকপুর, গোদাবাড়ী, চাঁনপুর, রাজারগাঁও, বড়গল্লা এবং দোয়ারাবাজারের লামাসানিয়া, টেংরাটিলা ও পাইকপাড়া গ্রামে রয়েছে অধিকাংশ লিচু বাগান।
ছাতক শহর থেকে সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে টিলা বেষ্টিত নোয়ারাই ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজার ও লিচুর গ্রাম হিসেবে পরিচিত মানিকপুর গ্রাম। একটু এগুলেই দোয়ারাবাজার উপজেলার লামাসানিয়া গ্রাম। মানিকপুর এলাকার প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে লিচুর গাছ। বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষ করেছেন এলাকার শতাধিক পরিবার। বর্তমান সময়ে ওই এলাকার বাগানগুলোর গাছে-গাছে ঝুলছে পাকা রসালো লিচুর ছড়া। যা দেখলেই চোখ-মন জুড়িয়ে যায়। লিচু বাগান দেখতে আসা দর্শনার্থীদের ভীড় এখানে কম নয়।
লিচু চাষি আবু তাহের জানান, চারা রোপনের তিন বছরের মাথায় ফল ধরা শুরু হয়। প্রাকৃতিক দূর্যোগে এবার ফলন কম হলেও অতীতে একটি বড় গাছ থেকে বছরে ২০ থেকে ৩০হাজার টাকা আয় করা সম্ভব ছিল।
এদিকে লিচুর গ্রাম নামে পরিচিত মানিকপুরসহ লিচু খ্যাত বিভিন্ন গ্রামের সাথে সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত নাজুক। ফলে চাষিরা এ অঞ্চলে তাদের উৎপাদিত লিচু সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে নিয়মিত ব্যর্থ হচ্ছেন। এজন্য এখানের উৎপাদিত লিচু কম খরচে স্বল্প সময়ে বাজারজাত করতে না পারায় আশানুরূপ লাভের প্রতিফলন ঘটছেনা বলে লিচু চাষিরা জানান।
লিচু চাষি ফরহাদ মিয়া বলেন, গত বছর লিচুর ফলন ভালো হয়েছিলো। কিন্তু ভয়াবহ বন্যায় সেগুলো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। আশা ছিল এবছর লিচু বিক্রি করে গত বছরের লোকসান পুষিয়ে নেব। কিন্তু চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত খরার কারণে অন্যান্য বছরের মতো লিচুর ফলন ভালো হয়নি। গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকের কম লিচুর ফলন হয়েছে। অনেক গাছে লিচুর মুকুল একেবারেই আসেনি। আর আসলেও লাগাতার খরায় তা ঝরে যায়।
তিনি আরোও জানান, কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর থেকে লিচু চাষে তাদেরকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করলে তারা স্বাবলম্বী হতে পারবেন। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে কম খরচে বাজারে লিচু সরবরাহ করা ছাড়াও যথারীতি বাইরের পাইকারদের আগমন বৃদ্ধিতে এলাকার লিচু চাষিরা স্বাবলম্বী হবেন বলে তিনি আশাবাদী। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেড়াতে আসা সিলেট জেলা বারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বলেন, ছাতক উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম মানিকপুর। মানিকপুরের লিচু সিলেট অঞ্চলে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে।
দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল পরিবার পরিজন নিয়ে মানিকপুর এসে নিজ হাতে লিচু পেরে খাবো। আলহামদুলিল্লাহ লিচু খেয়েছি। তবে আশানুরূপ লিচু চোখে পড়েনি। এখানকার লিচু চাষিরা জানসন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এবছর লিচু ফলন অন্য বছরের চেয়ে কম হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে যদি লিচু চাষিদেরকে নিয়ে প্রতিবছর লিচু চাষের উপর পরামর্শ ও দিকনির্দেশনামূলক সভার আয়োজন করা যায় তাহলে লিচু চাষে তাদের আগ্রহ বাড়বে।
তিনি আরও জানান, সুনামগঞ্জ জেলার বৃহত্তম লিচুর বাগান মানিকপুর গ্রাম। এই গ্রামটি টিলাবেষ্টিত হওয়ায় লিচু বাগানগুলোতে একটি পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে মানুষজন এখানে আসবে। তাতে মানিকপুর গ্রাম একটি বাণিজ্যিক ও পর্যটন শিল্পে পরিণত হবে। এতে এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা আরও প্রসারিত হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর মে মাসের শুরু থেকে গাছে গাছে পাকা লিচুর সমাহার ঘটে। সারাবছর পরিচর্যা করার পর ঠিক এ ওই সময়টিতে লিচু কিনতে আসেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। চাহিদা থাকায় ছাতক-দোয়ারাবাজারে বেড়েছে লিচুর বাণিজ্যিক চাষাবাদ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ওই এলাকার লিচু এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। তবে এবার খরা আর তীব্র তাপপ্রবাহে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম ফলন হয়েছে।
ছাতক উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তৌফিক হোসেন খান ও দোয়ারাবাজার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মহসিন আলী জানান, লিচু চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অনেককে লিচু চাষে উদ্যোগী করা হয়েছে। লিচুর ফলন ভালো রাখার জন্য সরকার থেকে অনেককে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে লিচুর ফলন কিছুটা কম হলেও চাষিরা পাচ্ছেন ভালো বাজারমূল্য। টিলা বেষ্টিত এ অঞ্চল লিচু চাষের উপযোগী হওয়ায় এখানে লিচুর বাগান করতে আগ্রহীদের সরকারি সকল সহযোগিতা দেয়া হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তারা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan